
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক ডালপালা মেলছে গুজব। পদ্মা সেতুতে কাটা মাথা লাগবে, স্কুলে স্কুলে ছেলেধরা, এরপর তিন দিন বিদ্যুৎ থাকবে না- এ রকম গুজবে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ফেসবুকের ইনবক্স। ইউটিউবেও ছড়াচ্ছে এ সব ভিত্তিহীন বিষয়। শুরুতে গুরুত্ব না দেওয়া হলেও গুজব এখন বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। ঘটছে একের পর এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। এরই মধ্যে ছেলেধরা সন্দেহে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণপিটুনিতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া গণপিটুনির ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে। সন্দেহের বশবর্তী হয়েছে অনেককে দেওয়া হচ্ছে পুলিশে। জনমনে এক ধরনের সন্দেহবাতিকতা জেঁকে বসেছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুজব ঠেকাতে এরই মধ্যে হার্ডলাইনে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এ সব গুজব আপাত নিরীহ মনে হলেও আদতে নিরীহ নয়। এর পেছনে রয়েছে সুদূরপ্রসারী সংঘবদ্ধ চক্র। দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ চক্র আশ্রয় নিয়েছে গুজবের। মূলত বিদেশে বসেই ছড়ানো হচ্ছে গুজব। দেশের সরলপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে এ সংঘবদ্ধ চক্র এক ধরনের ফায়দা নিতে চাই। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে নান তথ্য। পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী এ গুজবের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করেছেন। গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকেও এ অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আরব আমিরাতের দুবাই থেকে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। তিনি বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’ বাংলাদেশে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেও জানান পুলিশ প্রধান। জাবেদ পাটোয়ারী জানান, গুজব ছড়ানোর দায়ে এখন পর্যন্ত ১০৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং মামলা হয়েছে ৩১টি। ব্যবহৃত ৬০টি ফেসবুক আইডি, ২৫টি ইউটিউব চ্যানেল এবং ১০টি নিউজ পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে। এসব আইডি ও চ্যানেল থেকে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মাসের শুরুর দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ছড়ানো শুরু হয়। ফেসবুকের ইনবক্সে ‘পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করতে এক লাখ মানুষের মাথা লাগবে। মানুষের মাথা সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪২টি টিম ছড়িয়ে পড়েছে’- এ রকম আজগুবি মেসেজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৯ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর এ দেশের মানুষের মনস্তত্ত্বে আগে থেকেই এ ধরনের সরল বিশ্বাস থাকায় খুব দ্রুত ছড়াতে থাকে এ গুজব। নগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকাতে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের মধ্যে ভীতি, সন্দেহ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে স্কুলের সামনে থেকে ছাত্রী অপহরণের দুটি ঘটনাও ঘটে। এ খবরে মানুষের মাঝে ‘ছেলেধরা’ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ব্যাপক হারে গুজব ছড়িয়ে পড়লে সরকার ও পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে এটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন ও গুজব। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গুজব ছড়ানোর নেপথ্যে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। গুজব যারা ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে।
পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে সচেতনামূলক বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করে। কিন্তু গুজব প্রচারকারীরা পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার গুজব থেকে সরে এসে নতুন কৌশলে ছেলেধরার গুজব ছড়াতে থাকে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় গত ১৮ জুলাই। ওইদিন নেত্রকোণায় মাদকাসক্ত এক যুবক পূর্বশত্রুতার জেরে একটি শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে শিশুটির কাটা মাথা ব্যাগে ভরে মদ খেতে যায়। এ সময় ব্যাগ থেকে রক্ত ঝরতে দেখে শিশুর মাথা পাওয়া গেলে রবিন নামে ওই যুবককে গণপিটুনি দেয় জনতা। এতে তার মৃত্যু হয়। এ খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মনে আতঙ্ক বহুগুণ ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির একের পর এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে থাকে। এর মধ্যে বাড্ডায় মেয়ের ভর্তির তথ্য জানতে স্কুলে গেলে ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করে উন্মত্ত জনতা। মর্মান্তিক এ ঘটনায় তাসলিমার ছোট্ট অবুঝ শিশু তুবার কান্না বেদনাসিক্ত করে তোলে দেশবাসীকে। নারায়ণগঞ্জেও ঘটে রক্তহিম করা আরেক ঘটনা। মেয়েকে দেখতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারা যান বাবা। ছেলেধরা সন্দেহে আটটি গণধোলাইয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর সবগুলোর বলি সাধারণ মানুষ। পুলিশ প্রধান জাভেদ পাটোয়ারী বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি, গণপিটুনির প্রতিটি ঘটনা আমরা বিশ্লেষণ করেছি। গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের কেউই অপহরণকারী ছিল না, কেউই ছেলেধরা ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে গত কয়েক দিনে আটজনের প্রাণহানি হয়েছে।
গুজব প্রতিরোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত কয়েক দিনে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। জনগণের ভেতরে নানা সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। কাউকে সন্দেহ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দ্রুত জানাতে বলা হচ্ছে। ৯৯৯-এ ফোন করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গুজব এর ডালপালা মেলছেই। কেননা, পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে এ গুজব। তাই নতুন নতুন কৌশল ও নতুন নতুন বিষয়কে বেছে নিয়ে সরানো হচ্ছে গুজব। এরই মধ্যে ফেসবুকের ইনবক্সে ছড়িয়ে পড়েছে তিন দিন বিদ্যুৎ থাকবে না- এমন গুজব। বিদ্যুৎ বিভাগ এ বিষয়ে সতর্ক করে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দেশবাসীকে।
গতকাল বুধবার বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমদ কায়কাউস এই আহ্বান জানিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো সমস্যা নেই বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। জ্যেষ্ঠ সচিব কায়কাউস বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়াচ্ছে দেশে বিদ্যুৎ থাকবে না। এটা পুরোপুরি গুজব। চাহিদার বিপরীতে গতকাল ১১৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। কোথাও লোডশেডিং ছিল না। গতকাল বুধবারের মতো আজ কিংবা আগামীকালও চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। দেশে বন্যা সত্ত্বেও তেমনভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে না; আগামীতেও বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো সমস্যা হবে না। গুজব রটনাকারীদের বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানান তিনি।
শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, সরাসরিও ছড়ানো হচ্ছে গুজব। বিস্কুটের প্যাকেটে ‘কাল্লা চাই’ এ রকম গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায়। জানা গেছে, উপজেলার পাটুলী ইউনিয়নের পোড়াঘাটি গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির দরজার সামনে প্যাকেটগুলো ফেলে যাওয়া হয়; যেখানে লেখা আছে, ‘বিস্কুট দেয়া হয়েছে খাবেন, কিন্তু কাল্লা নেয়া হবেই’। এ ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে পোড়াঘাটি গ্রামে। পুলিশ ওই গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির সামনে ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে ৩০ প্যাকেট বিস্কুট ও হুমকি দেওয়া চিরকুট উদ্ধার করেছে। এ খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে জনমনে। গ্রামবাসী ভয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। কেউবা কাজে বের হলেও সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরছেন। স্কুলে যেতে পারছে না শিশু শিক্ষার্থীরা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) লীরা তরফদার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফিরোজ তালুকদার ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শন করেছেন। তারা গুজব সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে গ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করেন। এ সময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এসএম সাইফুজ্জামানও উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে গুজব প্রতিরোধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে ত্বরিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন, গুজবের মেসেজগুলো যেভাবে ও যত দ্রুত ভাইরাল হয়েছে এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে সেটার বিপরীতে প্রকৃত ঘটনা কি তা জানিয়ে যে পাল্টা প্রচারণা তাতে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। গুজব রটনাকারীরা খুবই পরিকল্পিতভাবে একের পর এক গুজব ছড়িয়েই যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি। কিন্তু সংঘবদ্ধ এ গুজব রটনাকারীদের গুজবের বিরুদ্ধে পাল্টা দ্রুত ও কার্যকর সাইবার এক্টিভিটিস চালাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। ফলে এখনো ডালপালা মেলছে গুজব।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply