
সাড়ে ৪ কোটি পরিবারের বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। বর্তমানে আমাদের দেশের তরুণ আছে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ। অর্থাৎ ৬৪ জেলায় গড়ে প্রতি জেলায় ৫ লক্ষ করে তরুণ আছে। আমরা জানি তরুণই শক্তি। তরুণ সমাজ ইচ্ছা করলেই যেকোনো অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। এর প্রমান আমরা দেখেছি। তরুণদের হাত ধরেই ৫২’তে আমরা ভাষা পেয়েছি, ৭১’এ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, ৯০’এ আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি! কিন্তু বর্তমানে দেশের যে ৭৩ লক্ষ মানুষ মাদকসেবী তার ৮২ শতাংশই আমাদের তরুণ সমাজ। মাদকসেবনে তারা প্রতি বছর ব্যয় করছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা! শুধু তাই নয়, এই বিশাল সংখ্যার মাদকসেবীরা কিন্তু বেশিরভাগই তরুণ এবং তারা তেমন কোনো কাজের সাথে জড়িত থাকে না। বিভিন্ন অবৈধ এবং অনৈতিক পন্থায় তারা এই টাকার যোগান দেয়। এর জন্য যেমন তাদের কাছ থেকে দেশ, সমাজ কিছু পাচ্ছে না, অপরদিকে সমাজের নিরাপত্তা এবং শান্তিও নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় বন্ধুদের পাল্লায় পরে বেশীরভাগ তরুণ শুধুমাত্র একবার মাদকসেবনের চিন্তা করে হারিয়ে যাচ্ছে এ নেশার জগতে। মাদকসেবনের কারণ গুলো চিহ্নিত করাও বেশ কষ্টসাধ্য। কারন আসলে মাদকসেবনের কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই! কেউ খুশিতে সেবন করে, কেউ অনেক দুঃখ পেয়ে সেবন করে, কেউ একাকিত্ম মোচনের জন্য করে, কেউ বা অনেকে একত্রিত হলে করে। তার মানে এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নাই। যারা মাদকসেবন করে, কোনো না কোনো একটা কারণ কে কারণ বানিয়ে তারপর মাদক সেবন করে। তবে আমাদের দেশে মাদকের সহজলভ্যতা মাদকসেবীদের মাদক সেবনে আরো বেশী আকৃষ্ট করে।
মূলত একজন মাদকসেবী মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পূর্বে কিছু লক্ষন দেখা যায়। ধীরে ধীরে পরিবার থেকে দূরে সরে যায়। সামাজিক ভাবে মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। আমাদের সমাজে বর্তমানে এমন অনেক পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে সন্তান কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে রুমের দরজা বন্ধ করে সারাদিন সারারাত কি করছে বাবা মা এর আর কোনো নজর থাকে না। এমন কি, প্রাইভেসির নামে তাদের রুমে আসা, বা আসার আগে দরজায় কড়া নেড়ে অনুমতি নিয়েও নাকি বাবা মা কে রুমে ঢুকতে হয়। এসব যে শুধু মাদকের জন্য ঝুঁকি তাই না, আত্মহত্যা এবং জঙ্গীবাদের মত ঘটনার স্বীকার হতে পারে আপনার সন্তান! শুধু মাত্র মাদকের কারনে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের দেশের লাখো তরুণ!
মাদকের এই কঠিন সমস্যার শুরুটা কিন্তু হয় ধূমপান দিয়ে। বর্তমানে ধূমপান বন্ধে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও তামাকজাতপন্যের মূল্য অনেক বেশী বাড়ানো হয়েছে। তবে এতে হয়তোবা ধূমপানের পরিমান কিছুটা কমবে, কিন্তু বন্ধ হবে না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ টাকার তামাকজাতপন্য বিক্রয় হয়! প্রতি বছর আমাদের দেশের মানুষ ধূমপান করে নষ্ট করছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা! যা আমাদের দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ৪ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ! অর্থাৎ এই ৮০ লাখ মানুষ কিন্তু মাদকের ঝুঁকিতে আছেন। বিশেষ করে তরুণ ধূমপায়ীরা এই ঝুঁকিতে বেশী আছেন।
এই বিশাল তরুন সমাজকে মাদকের আগ্রাসন থেকে দূরে রাখার জন্য যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে তাদের সামাজিকীকরণ। পরিবার এবং সমাজের মানুষের সাথে বেশী বেশী মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া। পরিবারের সদস্যদের মাঝে সময় দেওয়া, কথা বলা, বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদির প্রচলন করতে হবে। যা কিনা আমাদের সমাজে অনেক বেশী প্রচলিত ছিলো। এছাড়া আরেকটি বিষয় যেটা পড়াশুনার পাশাপাশি যে সময়টা পাওয়া যাবে তা যেন কোনো গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে ব্যয় করা। যেমন-বই পড়া, লিখালিখি করা অর্থাৎ সাহিত্য চর্চা, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো তরুণ প্রজন্মের জন্য খুব ভালো একটি ট্রেন্ড। সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকা তরুন প্রজন্ম নেশার জগতে যাওয়ার সময়টাই যে খুঁজেও পাবে না! যে তরুণ সারাক্ষন চিন্তা করতে থাকে কার রক্ত লাগবে, কোথায় গরীব মানুষদের সাহায্য করবে, কোথায় পথশিশুদের পড়াশুনা করাবে, তার মাথায় মাদকের চিন্তা আসার প্রশ্নই আসে না!। ইদানিং আমরা দেশর বিভিন্ন প্রান্তে দেখছি ছোট বড় অনেক সামাজিক সংগঠন বা ক্লাব গড়ে উঠেছে। এই ক্লাব বা সংগঠনগুলোর বেশীর ভাগই তরুণদের হাতেই পরিচালিত। সারা বছর তাদের ব্যাস্ত দেখা যায় অসহায় মানুষের সহায়তা করতে। ঈদে মানুষ কে নতুন কাপড় দেওয়া, খাবার দেওয়া, সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের চিকিৎসা সেবা, গরীব বাচ্চাদের পড়াশুনা, বয়স্ক শিক্ষা ইত্যাদি কাজে সারা বছর পরাশুনার পাশাপাশি সংগঠন গুলো ব্যস্ত থাকে। এই কাজে সরকারী আরো সহযোগীতা প্রয়োজন। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার। তরুণদের আরো বেশী বেশী উদ্বুদ্ধ করতে হবে নিজেদের সামাজিক কাজে জড়িত রাখার জন্য। এর মাধ্যমে তরুণ রা যেমন সামাজিক হবে, নিজেকে ভালো কাজে ব্যস্ত রাখতে পারবে, সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করার সুযোগ পাবে, দেশের প্রতি ভালোবাসা বাড়বে, অপর দিকে নেশার জগত থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। যেই তরুন নেশা করতো, সেই তরুণ দেখা যাবে কোনো সামাজিক সংগঠনে মাদক বিরোধী সচেতনতা আনুষ্ঠানের আয়োজন করছে! অর্থাৎ সব মিলিয়ে তরুণ সমাজ কে ব্যস্ত রাখতে হবে। তা না হলে যে ৩ কোটি ২০ লক্ষ ‘জেনারেশ জেড’ এর উপর নির্ভর করে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকশই উন্নয়ন লক্ষ মাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছি তা কখনো পূরণ করা সম্ভব হবে না।
লেখকঃ
এস এম আশেক উল্লাহ সোপান
কেন্দ্রীয় সভাপতি,
বাংলাদেশ স্টুডেন্ট কাউন্সিল।
শিক্ষার্থী, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply