
রাজধানী ঢাকা এখন একটি আতঙ্কের নাম। এখানে থেমে নেই মৃত্যু। থেমে নেই বীভৎসভাবে মৃত্যুর তালিকা। এ তালিকা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে ক্ষতির পরিমানও। দেড় মাসের মাথায় চারটি বড় ধরনের আগুনের ভয়াবহতার শিকার হয়েছে রাজধানী ঢাকা। গতকাল গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটের কাঁচা বাজারে ভোর পৌনে ছয়টার দিকে ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট, সেনাবাহিনী এবং র্যাব। সকলের সমন্বিত চেষ্টায় সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনের ভয়াবহতায় পুড়ে গেছে মার্কেটে থাকা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেকেরও বেশি দোকান। তবে আগুনে ক্ষতির পরিমান সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ঘটনায় কোন প্রাণ না গেলেও পরপর চারটি ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডে রাজধানী ঢাকা যেন নাম নিয়েছে ‘মৃত্যুশঙ্কা’।
এদিকে ঘটনার পর সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এর আগেও এখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কেন বারবার এই অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখা হবে। এখন সময় এসেছে স্থায়ী সমাধান করার।
একইদিন ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে এসে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘এই মার্কেটটি ভেঙে আন্তর্জাতিক মানের শপিং মল করার কথা ছিল। যে কোনও কারণে সেটি করা হয়নি। কিন্তু এখন জনগণের স্বার্থে যে কোনও মূল্যে এটাকে ভেঙে মার্কেট তৈরি করতে হবে।’
এই ঘটনার ঠিক দুইদিন আগে রাজধানীর আরেক বিলাসবহুল এলাকা বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুন লাগে। গত ২৮ মার্চ দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে ২২ তলা এ ভবনের ৯ তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট সহ বিমান বাহিনী, সেনা বাহিনী এবং নৌ বাহিনীর চেষ্টায় প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু আগুনের এ ভয়াবহতায় প্রাণ হারান ২৫ জন মানুষ। ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় নিহত হন এক শ্রীলংকান নাগরিক। এছাড়াও ভবনের ভেতর ধোঁয়ার প্রচন্ডতায় প্রাণ হারান কয়েকজন। এ ঘটনায় আহত ব্যক্তির সংখ্যা ৭০জনেরও বেশি।
এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের ভাষানটেক থানাধীন জাহাঙ্গীর বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় পুড়ে যায় বস্তিবাসীদের বেশকিছু ঘর। রাত ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ১৮ টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুনে সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায় কয়েকশ মানুষের সর্বস্ব। স্থানীয়রা জানান, টিনের তৈরি এই বস্তিতে কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, কাঠের গুদাম, পোশাকের দোকান, এতিমখানা ও কয়েকটি আবাসিক ঘর ছিল। যেখানে শতাধিক মানুষ রাত-যাপন করতেন। বস্তির সঙ্গে লাগোয়া রাস্তার পাশে ফার্নিচারের প্রায় সব দোকান পুড়ে যায় সে ঘটনায়। সে ধ্বংসস্তূপ থেকে রক্ষা করা যায়নি প্রায় কিছুই। অগ্নিকান্ডে সে মুহূর্তে কোনো হতাহতের ঘটনা না শোনা গেলেও পরদিন বস্তির পাশের ডোবা থেকে ছয় মাস এবং সাত বছর বয়সী দুটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।
মিরপুরের এই ঘটনার ঠিক সপ্তাহখানেক আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত দশটার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। সে রাতে সেখানে সিলিন্ডার গ্যাস বিস্ফোরণে কেমিক্যালের গোডাউনে আগুন লেগে মৃত্যু হয় ৭১ জন মানুষের। এদের মাঝে ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় ঘটনাস্থল থেকে। বাকিদের মৃত্যু হয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শতাধিকেরও বেশি। ভয়াবহ সে ঘটনা স্তব্ধ করে দেয় পুরো দেশসহ বিশ্ববাসীকেও। দুর্ঘটনার পরই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন জানান, রাজধানীর পুরান ঢাকায় আর দাহ্য পদার্থের গোডাউন রাখতে দেওয়া হবে না। এলাকায় যে সব মালিকের বাড়িতে কেমিক্যালের গোডাউন ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। তার এ ঘোষণার পরপরই পুরান ঢাকা থেকে সকল প্রকার কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, সদরঘাট ও সিদ্দিকবাজারে মোট ৪৬৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত ১০ বছরে সারা দেশে ১৬ হাজার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)। এসব অগ্নিকান্ডে এক হাজার ৫৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানান বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
রাজধানীর বেশিরভাগ ভবনই নির্মাণের সময় মেনে চলা হয় না সঠিক নিয়ম। আর এ কারণে নিয়মিত ঘটছে বড় বড় দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে বহুতল ভবন রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯শর বেশি, যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশেরই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। এই হিসেবে প্রায় ২৭শ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। জানা যায়, ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখ স্থাপনা রয়েছে। একতলা থেকে ৬ তলার স্থাপনা ২১ লাখ ১২ হাজার আর ৭ তলা থেকে ২৪-২৫ তলা ভবন আছে ৮৮ হাজার। এর মধ্যে ১০ তলা এবং ১০ তলার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বহুতল ইমারত রয়েছে ২ হাজার ৯শর বেশি।
জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইমারতের নকশা অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রাজউকের হাতে। এসব ইমারত নির্মাণে রাজউক প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার নকশার অনুমোদন দেয়। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট-১৯৫২ এবং বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি); রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এবং ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী এসব ভবনের নির্মাণকাজ মনিটরিং করার দায়িত্ব রাজউকের হলেও সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে গড়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন।
নগর পরিকল্পনা শাখার এক কর্মকর্তা বলেছেন, ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখ স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে একতলা থেকে ৬তলা পর্যন্ত স্থাপনা ৯৬ শতাংশ, ৭ তলা থেকে শুরু করে বহুতল ভবনসহ স্থাপনা আছে ৪ শতাংশ। সেই হিসেবে ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় ৭ তলা থেকে শুরু করে ২৪-২৫ তলা পর্যন্ত ভবনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮ হাজার। তবে রাজধানীতে বহুতল ভবনের সংখ্যা বেশি নয়। যা আছে সেগুলোর বেশিরভাগ রয়েছে মতিঝিল, গুলশান ও বনানী এলাকায় বলে জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালায় বহুতল ভবনগুলোয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি অগ্নি-প্রতিরোধক দরজা; অগ্নি-প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণ এবং অগ্নি-নিরাপদ সিঁড়ি রাখার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করেন না ইমারত মালিকরা।
এ বিষয়ে রাজউকের এক অথরাইজড অফিসার বলেন, ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভবনের সিঁড়ির প্রশস্ত ন্যূনতম ৫ ফুট হতে হবে। কোনো ভবনের উচ্চতা ১০ তলার বেশি হলে সেই ভবনে ৫ ফুট প্রশস্তের দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। দশতলার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন ভবনে ফায়ার সিস্টেম ইক্যুপমেন্ট স্থাপন করতে হবে।
ভবন মালিকদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিজ উদ্যোগে ফায়ার সিস্টেম ইক্যুপমেন্ট স্থাপনের এ বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তদারকি করবে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসকে তা করতে দেখা যায় না বলেও অভিযোগ উথাপন করেন তিনি।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply