
নিলয় ধর, যশোর প্রতিনিধি : যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়)’ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয় ডিপিপি সংশোধন করেছে। ডিপিপি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশোধিত ডিপিপিতে টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় নদী পুনর্খনন, নদী ড্রেজিং, খাল পুনর্খনন, খালের ওপর কালভার্ট নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, স্লুইস নির্মাণ ও মেরামত রাখা হয়েছে। তবে ভবদহ জলাবদ্ধতার নিরসনে সবচেয়ে কার্যকারী জোয়ারাধার (টিআরএম-টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট) ডিপিপিতে রাখা হয়নি। এর আগে ৪৪৮ কোটি ৭১ লাখ ২৩ হাজার টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়)’ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ডিপিপি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত যাচাই কমিটির সভায় প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। বাতিলের কারণ হিসাবে বলা হয়, জোয়ারাধার বাস্তবায়ন হলে জলাশয় ভরাট হবে। ফলে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া, স্থানীয় জনগণ জোয়ারাধার চান না।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জোয়ারাধার প্রকল্পটি বাতিল করা হলেও ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’ বাতিল করা হয়নি। সভায় ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে এই প্রকল্পের আওতায় নদী ও খাল খনন এবং বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়। সে অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয় ডিপিপি সংশোধন করে সংশোধিত ডিপিপি গত ৩০ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। সংশোধিত ডিপিপিতে ১০৭ দশমিক ৯০ কিলোমিটার নদী পুনর্খনন, ৩০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং, ৬২টি খালের ২৬৪ দশমিক ৫১ কিলোমিটার পুনর্খনন, বিভিন্ন খালের ওপর ১৯টি কালভার্ট নির্মাণ, ৫০ দশমিক ২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, একটি স্লুইস নির্মাণ ও ১৯টি স্লুইস মেরামত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশোধিত ডিপিপিতে জোয়ারাধার রাখা হয়নি।
তবে সংশোধিত ডিপিপির প্রকল্পের পটভূমির অংশে বলা হয়, ২০১৩ সাল থেকে বিল খুকশিয়ায় সাত বছর মেয়াদী টিআরএম (জোয়ারাধার) কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ হয়ে যায়। বিল খুকশিয়ায় টিআরএমের পর বিল কপালিয়ায় টিআরএম পরিচালনা সম্ভব না হওয়ায় ২০১৩ সাল থেকে সাগরবাহিত পলি ভবদহ ও তৎসংলগ্ন এলাকার নদী ও খালগুলোকে ক্রমান্বয়ে ভরাট করে ফেলে। ফলে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বর্ষাকালে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার উদ্ভব হয়। মূল নদী সংলগ্ন যেকোন একটি নির্বাচিত বিলের তিনদিকে পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ করে অবশিষ্ট দিকের বেড়িবাঁধের একটি অংশ উন্মুক্ত করে বিলে জোয়ারভাটা চালু করা হয়। এটাই জোয়ারাধার নামে পরিচিত।
এই পদ্ধতিতে সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি পর্যায়ক্রমে এলাকার একটি করে বিলে ফেলে বিল উঁচু করার পাশাপাশি নদীর নাব্য বৃদ্ধি হয়। জোায়ারাধার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের শত শত বছরের পুরানো নিজস্ব উদ্ভাবিত একটি কৃষি-পদ্ধতি। অতীতে কৃষকেরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নদীতে বাঁধ দিয়ে নোনা পানি ঠেকিয়ে আবাদ করতেন এবং আবাদ শেষে বাঁধ কেটে জোয়ারে পলি তুলে বিল উঁচু করে নিতেন। এর নামই অষ্টমাসী বাঁধ। মাঘী পূর্ণিমায় বাঁধ দিয়ে আষাঢ়ী পূর্ণিমায় খুলে দেয়া হতো। এইভাবে একই সঙ্গে চলতো চাষাবাদ আর ভূমি গঠনের কাজ। এতে নদীতে নাব্য থাকত। নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হওয়ায় কোন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতারা জানান, ভবদহ অঞ্চলে জোয়ারাধার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ মাসে যশোরে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় কর্মশালায়। তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ কর্মশালায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরের শুষ্ক মৌসুমে জোয়রাধার বাস্তবায়ন শুরু হবে। কিন্তু এরপর কার্যক্রম আর এগোয়নি। পরে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রী জোয়ারাধার বাস্তবায়নের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এরপর থেমে যায় প্রকল্পটি। গত ২ আগস্ট পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রকল্প প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেন। তারা জানান, গত ১৮ জুলাই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার ভবদহ পরিদর্শনে এসে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময়কালে তিনি ঘোষণা দেন, জোয়ারাধার ভবদহ জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের কোন পথ নয়। এতে জলাশয় নষ্ট হবে। সমস্যা সমাধানে নদী-খাল কাটতে হবে। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘নদী কেটে নদী বাঁচানো যায় না, নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল নদী বাঁচানো সম্ভব।
নদী বাঁচাতে সাগর থেকে উঠে আসা পলি বিলে বিলে ধারণ এবং উজানের পানি প্রবাহের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘গত চার বছর ধরে কেবল নদী কাটা হচ্ছে। এতে নদীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এই বছর নদীগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদী পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। সমস্যা সমাধানে টিআরএমের কোনই বিকল্প নেই। এক গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে গৃহীত বিল কপালিয়ার টিআরএম প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। টিআরএম প্রকল্প বাতিল খুবই হতাশাজনক, গণবিরোধী এবং এই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদী ও ভূমি সম্পর্কিত জনগণের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক মতামতের পরিপন্থী। এতে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। মহল বিশেষ এই অর্থ লোপাটের সুযোগ পাচ্ছে।
যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার পাশে মজ্জাতের বাওড়ের বিপরীত দিকে ভৈরব নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে মুক্তেশ্বরী নদী যশোর সদর ও মনিরামপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর অভয়নগর উপজেলার গোঘাটা নামক স্থানে টেকা নাম ধারণ করেছে নদীটি। টেকা নদী উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় শ্রী নদীতে পতিত হয়েছে। শ্রী নদী কিছু দূর এগিয়ে মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়ায় হরি নদীর সঙ্গে মিশেছে। হরি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গ্যাংরাইল নদীতে মিশেছে যশোর শহরসহ ভবদহ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশিত হয় মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী দিয়ে। সাগর থেকে আসা জোয়ার প্রতিদিন দুইবার নদীগুলো দিয়ে ভবদহ অঞ্চলে প্রবেশ করে। আবার একইভাবে সাগরে ফিরে যায়।
কিন্তু পলি পড়ে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্য হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় গত কয়েক বছর বর্ষা মৌসুমে ভবদহ অঞ্চলের অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মাছের ঘের, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয় এলাকার কমপক্ষে চার লাখ মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড, যশোরের কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন,‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন ও টেকসই পানি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন করে পাঠানো হয়েছে। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় টিআরএম নেই। এতে নদী পুনর্খনন, নদী ড্রেজিং, খাল পুনর্খনন, খালের ওপর কালভার্ট নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, স্লুইস নির্মাণ ও মেরামত রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রকল্প প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখানে যাচাই কমিটির সভায় পাশ হবে। এরপর পরিকল্পনা কমিশনে দুটি সভার পর তা পাস হবে। এরপর পুনর্গঠিত ডিপিপি যাবে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের পর জোয়ারাধার বাস্তবায়ন শুরু হবে।’
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
খবরটি যদি গুরুত্বপুর্ন মনে হয় তাহলে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার করুন
Leave a Reply