
আজ রোববার পূর্ণ হলো হেফাজত ইসলামের তাণ্ডবের ছয় বছর।
২০১৩ সালের ৫ মে (রোববার) ঢাকা ঘেরাও এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিতে মতিঝিল-পল্টনসহ আশপাশ এলাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
চরম এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয় সেদিন। আর সেটা তৈরি করে হেফাজতে ইসলাম। কেটে ফেলা হয় সড়কের দু’পাশে শত শত গাছ। এমনকি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআন শরীফে আগুন দেওয়া হয়। তাদের নৃশংস হামলা থেকে রক্ষা পায়নি ফুটপাতের শত শত দোকানিও।
হেফাজতের চরম বর্বরতা ও নৃশংসতার সাক্ষী হয়েছিল রাজধানীবাসী।
৫ মে (রোববার) গভীর রাতে পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো অভিযানের মুখে মতিঝিল ছাড়তে বাধ্য হয় হেফাজতের উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীরা।
২০১৩ সালে হেফাজতের তাণ্ডবের পরপরই সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল তাদের আড়াই হাজার কর্মী ও সমর্থক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতও একই ধরনের কথা বলে আসছে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ দাবি করে ৬১ জন নিহত হয়। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে হেফাজত ও অধিকারের দেওয়া তথ্য ভুল।
পুলিশ পরে জানায়, হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষে রাজধানীতে এক পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এরপর ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্রকে গ্রেফতার করা হয়। পরে অধিকারের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ‘কথিত নিহতদের তালিকা উদ্ধার করা হয়।
যেভাবে আলোচনায় হেফাজতে ইসলাম
আল্লাহ ও রাসূলকে (সা.) অবমাননাকারী ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসির দাবিতে রাজপথে নেমে ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে আলোচনায় আসে হেফাজত। একই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিলে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়।
৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ ও বিশাল মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেও উত্থান হয় হেফাজতের। তাদের কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব ধর্মভিত্তিক দল সমর্থন দেয়। ১৩ দফা দাবি আদায়ে ৫ মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে টানা অবস্থান নিয়েছিল হেফাজত।
৫ মে মধ্যরাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে উচ্ছেদ করা হয়। হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দাবি করে, শাপলা চত্বরের অভিযানে দেড় হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর প্রাণহানি হয়েছে। তবে পরে হেফাজতের ‘তালিকায়’ দাবি করা হয়, ৮৯ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। ‘হত্যাযজ্ঞের’ প্রতিবাদে ৮ মে দেশব্যাপী হরতাল ডাকে হেফাজত। এটাই ছিল সংগঠনটির দেশব্যাপী সর্বশেষ কর্মসূচি।
সমর্থন ছিল বিএনপি-জামায়াতের
হেফাজতভুক্ত সরকারবিরোধী ১৯ দলীয় জোটের শরিক ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সিদ্ধান্তে টানা অবস্থানের কর্মসূচি দেওয়া হয়। তাদের অভিমত ছিল, টানা অবস্থান নিলে সরকার পতন হবে। বিএনপি-জামায়াতও সমর্থন দিয়েছিল। তবে মাদ্রাসাভিত্তিক নেতারা তার বিরোধী ছিলেন।
মামলার হাল হকিকত
হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় সারা দেশে ৮৩টি মামলা হয়। তার মধ্যে বাগেরহাটের একটি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। রায়ে সব আসামি খালাস পেয়েছেন। দুটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। বাকি ১৮ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও বিচার শুরু হয়নি। হেফাজতের বিরুদ্ধে রাজধানীতে করা ৪৯ মামলার তদন্ত চলছে। হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় যে মামলাগুলো দায়ের করা হয়, তাতে ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়।
হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীকে কোনেও মামলাতেই আসামি করা হয়নি। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান।
সেই দিনের ঘটনাপঞ্জি—
ঢাকা অবরোধের নামে তাণ্ডব
রোববার ( ৫ মে ২০১৩) ঢাকা অবরোধের নামে মতিঝিল এলাকায় প্রায় ৮ ঘণ্টা তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। এতে মতিঝিল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়৷ হেফাজতের কর্মীরা দোকানপাট, মার্কেট, বাণিজ্যিক ভবন, অফিস, গাড়ি সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দেয়৷
ওই দিন ভোর পাঁচটা ফজরের নামাযের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।
ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়দাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারাদেশ থেকে আসা
বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবরোধকারীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়াতে থাকলো, যখন এর নেতৃত্ব ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ
হেফাজত যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল তখন পুলিশ বাধা দিতে গেলে তাদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়৷ মতিঝিল এলাকা পরিণত যুদ্ধক্ষেত্রে। শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, সেখানকার আবাসিক ভবনগুলোতে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷
এর আগে হেফাজতে ইসলামের নেতারা শাপলা চত্বরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর অনুমতির জন্য পুলিশের সাথে আলোচনা শুরু করেন।
ওই দিন সকালে দফায় দফায় তাদের অলোচনা চলে। সকাল সাড়ে ১১টা অনুমতি মেলার আগেই কয়েকটি মিছিল ঢুকে পড়ে এবং সংঘর্ষ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এবং পল্টন এলাকায়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে ।
ওই সময় দায়িত্বরত এক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান,শেষ পর্যন্ত পুলিশ অনুমতি দিয়েছিল শাপলা চত্বরে এসে শুধু মোনাজাত করেই কর্মসূচি শেষ করার শর্তে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এবং পল্টন এলাকায় সহিংসতা চলেছিল সন্ধ্যার পরও।
রাতে অভিযান
সমাবেশের জন্য বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সময় বিকেল ৫টার পরও শাপলা চত্বরে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দেয় হেফাজতের কর্মীরা৷ এরপর রাত আড়াইটার দিকে বিজিবি, ব়্যাব ও পুলিশের যৌথ বাহিনী মতিঝিলকে ঘিরে অভিযান শুরু করলে ১০ মিনিটের মধ্যেই হেফাজতের কর্মীরা পিছু হটে যায়।
ওই দিন রাত পৌনে তিনটায় শুরু হয় মূল অভিযান। এর আগে সন্ধ্যার দিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হেফাজতে ইসলামীর কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেয়। মূলত তার এই বিবৃতির পর থেকে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হেফাজতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত রাউন্ড গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।
এই অভিযানের নেতৃত্বে থাকা অন্যতম পুলিশ কর্মকর্তা জানার, ১০ মিনিটেই তারা পৌঁছে যান শাপলা চত্বরে। অভিযানের সময় হেফাজতের শত শত কর্মী সমর্থক মতিঝিল এলাকায় বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেন।
পুলিশ পুরো এলাকার দখল নেওয়ার পর বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেওয়াদের বের করে এনে ওই এলাকা ছেড়ে যেতে সহায়তা করে।
কাঁচপুরে অবস্থান
মতিঝিল থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর হেফাজত কর্মীদের বড় একটি অংশ সোমবার (৬ মে ১৩) সকালে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এবং সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থান নেয়৷ তারা সেখানে পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন ও পুলিশের ওপর হামলা চালায়।
হামলার শিকার সংবাদমাধ্যম
হেফাজতের হামলা থেকে মুক্তি পায়নি গণমাধ্যমের কর্মীরাও৷ এছাড়া পল্টন এলাকায় অবস্থিত ব়্যাংগস ভবনের ‘সকালের খবর’ পত্রিকা অফিসে আগুন দেয়।
ওই দিন সংবাদ সংগ্রহ করার সময় রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় হামলার শিকার হয়েছেন একুশে টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নাদিরা শারমিন। পুরুষদের মধ্যে নারী রিপোর্টার কেন? -এমন প্রশ্ন তুলে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা নাদিরাকে পেটাতে পেটাতে দিগন্ত টিভির কার্যালয়ের সামনে নিয়ে যায়। পরে মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নাদিরা ছাড়াও হেফাজত কর্মীদের হামলায় আরও ৭ সংবাদকর্মী আহত হন।
দায়িত্ব পালনের সময় হেফাজত কর্মীরা প্রথমে সাংবাদিকদের ‘দালাল-নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে গালিগালাজ করে। এক পর্যায়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply