
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে অস্বাভাবিক ঘটনাই ঘটেছে। বিক্ষোভ করেছেন রোহিঙ্গারা। বিক্ষোভ অবশ্য আশ্রয়দাতা দেশ বা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সিদ্ধান্ত বা আচরণের বিরুদ্ধে নয়; এটি জাতিসংঘের বিরুদ্ধে।
মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউএনডিপি এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে যে সমঝোতা স্মারক সই করেছে, এই প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়ে তাঁদের মতামত নিতে হবে। তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রত্যাবাসন হতে হবে মর্যাদার সঙ্গে, যার মানে হচ্ছে জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি এবং পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার। এরপর তাঁরা নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথাও বলেছেন। ইউএনএইচসিআরের প্রতি তাঁদের খোলামেলা দাবি, সমঝোতা স্মারক, এমওইউ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক সই করেছে ৬ জুন, তা এখনো প্রকাশ করেনি।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি জাপানের এনএইচকে টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিয়ানমার যে উদ্বাস্তুদের প্রতি তার সব দায়িত্বই পালন করছে, এই চুক্তি তার নিদর্শন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এই চুক্তি পড়ে দেখারও আহ্বান জানান।
সু চি যে চুক্তি পড়ে দেখতে বলেছেন, সেই চুক্তি তিনি এবং জাতিসংঘের দুই সংস্থার কেউই প্রকাশ করেনি। চুক্তিটির কপি পাওয়ার জন্য কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা, এনজিও, জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের তা দেওয়া হয়নি। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা ১২ জুন জানিয়েছে, নেপিডোর পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্র তাদের জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকারের আপত্তির কারণেই চুক্তিটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। পত্রিকাটি মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে তিনিও পত্রিকাটিকে বলেছেন, এটি প্রকাশের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করছেন।
রোহিঙ্গা সংকটের সাম্প্রতিকতম পর্বের শুরু গত আগস্টে, যখন কথিত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরসার বিদ্রোহীদের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার জবাবে সেনাবাহিনী বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচার অভিযান পরিচালনা করে। তারপর থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর নিপীড়ন-নির্যাতনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।
এবারে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা এর আগেও পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নতুন করে নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। সঙ্গে আছেন প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় আগে থেকে থাকা আরও প্রায় তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সুতরাং, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘ সংস্থাটির ওপর আস্থা না রাখতে পারাই স্বাভাবিক।
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেশটির দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আইসিসি। স্পষ্টতই এ পদক্ষেপের কারণে মিয়ানমার সরকার একটু বিচলিত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই গত ৩১ মে সু চি নতুন আরেকটি কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন।
এবারের কমিশনের কাজ হবে কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্ত করা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নতুন কমিশন গঠনের এই উদ্যোগকে ধোঁকা অভিহিত করে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে তারা যেন দেশটির অপরাধ বিচারের জন্য আইসিসিতে পাঠায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিক্ষোভকারী রোহিঙ্গাদের দাবি, যে চুক্তি তাঁদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে, সেই সমঝোতায় তাঁদের মতামত উপেক্ষা কোন যুক্তিতে? একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ওপর এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো গণতন্ত্রসম্মত নয়।
চুক্তিতে সই তো হলো। এবার শেষ পর্যন্ত দেখার বিষয়, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সত্যিই কতটা আন্তরিক। কিংবা রোহিঙ্গা এই জনগোষ্ঠী নিজেরাও ফিরে যেতে চায় কিনা, সেটিও বড় প্রশ্নের মুখে এসে পড়েছে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ ও এস
Leave a Reply