গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়া, শিমূল, পলাশের মেলা দেখতে কার না ভালো লাগে। এরই মধ্যে বন-বনান্তে কাননে কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহলে চারদিক ভরে উঠেছে। বাঙালির মনেও লেগেছে রঙের দোলা। হৃদয় হয়েছে উচাটন। এর সঙ্গে সঙ্গে শুকনো পাতায় ভর করে আমাদের মাঝে আগমন ঋতুরাজ বসন্তের। বসন্তের প্রথম দিন আজ পহেলা ফাল্গুন। শিমুল বন আর কৃষ্ণচূড়ারা সেজেছে সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্তিম রঙে। কোকিলরা গান ধরেছে ভ্রমরের
গুনগুনানির তালে তালে। চারদিকে শোনা যায় ঝরা পাতার নিক্কণধ্বনি। পহেলা ফাল্গুনে, বিশেষ করে তরুণীরা বাসন্তী রঙের শাড়ি আর মাথায় হলুদ ফুল দিয়ে নিজেদের নতুন করে সাজিয়ে তোলেন। অন্যদিকে ছেলেরা সাজেন হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে। গ্রামবাংলায় বিশেষ আয়োজনে চলে পিঠা উৎসব। আর শহরে এটি পায় বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা। ফাল্গুন মানেই হলুদ কিংবা বাসন্তী শাড়ি পরে সবাই বসন্তকে বরণ করে নেয়। কিন্তু এ ফাল্গুনে কোনোভাবেই ইচ্ছে করছে না হলুদ শাড়ি পরার, অন্য কোনো গাঢ় রঙের শাড়িই পরতে চায়। পাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলের মধুর কুহুকুহু ডাক ব্যাকুল করে তুলবে অনেক বিরহি অন্তর। কবি তাই বলেছেন, সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে…। ফাল্গুন আসার আগেই অবশ্য আমমঞ্জরি
কোষগুলো পরিণত হতে থাকে। কাঁঠাল গাছের শাখায় শাখায় ধরে মুছি (মুকুল)। লিচু গাছগুলোও ফলবতী হয়ে উঠেছে। এর চেয়েও বেশি বসন্তকে উপলব্ধি করা যায় রক্তিম পলাশ, শিমুল, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, গামারী আর মৃদুগন্ধের ছোট ছোট বরুণ ফুলে। এছাড়া গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়াসহ হাজারো
নামের বর্ণালি ফুল তো বসন্তের সাজ আভরণ হিসেবেই বিবেচ্য। পৌষ-মাঘের জ্বরা-ব্যাধির আসর এসে পড়ে পরের মাসেও। গরম অনুভূত তথা ঋতু বদলের বাতাস বইতে না বইতে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, পানিবসন্ত ইত্যাদি রোগ দেখা দেয়। চিকিৎসকরা এ সময়ে সর্বসাধারণকে সচেতন হয়ে চলার পরামর্শ দেন। বসন্ত ঋতু লুকিয়ে আছে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের ভেতর। তবে অনুভবের জায়গা থেকে বলতে গেলে শুধু ফাল্গুন মাসের কথাই বলতে হবে। বাংলা বছর গণনায় ফাল্গুন ১১তম মাস হলেও কালের আবর্তনে এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি শুধু একটি মাসের নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ ফাল্গুন মাসকে নিয়ে আমাদের
লোকগানের পাশাপাশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে নানা রচনা। যেমন বাউল সুরে গাওয়া হয়Ñ নারী হয় লজ্জাতে লাল, ফাল্গুনে লাল শিমুল বন, এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন… মন রে… এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন। নারী লজ্জাতে লাল হয় না পুরুষ লজ্জাতে লাল হয়Ñ তা বিতর্কের বিষয়। তবে ফাগুনের মাসে শিমুলের বন যে লাল হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেনÑ ফাল্গুনে বিকশিত/ কাঞ্চন ফুল, ডালে
ডালে পুঞ্জিত/ আম্রমুকুল। চঞ্চল মৌমাছি/ গুঞ্জরি গায়, বেণুবনে মর্মরে/ দক্ষিণ বায়। ফুল যদি ঝরে যায়, নদী যদি মরে যায়/ ফাল্গুন আসবেই এ দেশে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক, আজ বসন্ত। দিনেই অসংখ্য তরুণী বাসন্তী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, গ্রন্থমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী সুশোভিত করে তোলেন। বসন্তের পূর্ণতার এ দোলা ছড়িয়ে পড়–ক বাংলাদেশের সর্বত্র এবং সারা পৃথিবীর সব বাঙালির ঘরে ঘরে। ২২ বছর আগে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম বসন্ত উৎসব উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত
উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। বসন্তের নাচ, গান ও কবিতার পাশাপাশি ফুলের প্রীতিবন্ধনী ও বসন্ত কথনের মাধ্যমে রাজধানীর চারটি স্পটে বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় পহেলা ফাল্গুন গতকাল মঙ্গলবার আয়োজন হবে বসন্তের উৎসব। এদিন চারুকলা থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব ছড়িয়ে পড়বে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ্ পার্ক এবং উত্তরার ৩নং সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে। এটি আয়োজন করছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply