
নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালে প্যাথলজি ফি ও ডাক্তারি পরীক্ষার মূল্য তালিকা প্রদর্শন কার্যকর হচ্ছে না। দাবিটি বাস্তবায়নে কয়েকবার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধন করেছে সরকার। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালে প্যাথলজি ও ডাক্তারি পরীক্ষার ফি ইচ্ছেমতো আদায় করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শুধু তাই নয়, রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নিম্নমানের হাসপাতাল।
এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। ডাক্তারি পরীক্ষার ফি নিয়েও চলছে অরাজকতা। চলতি বছরের ২৪ জুলাই দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন প্যাথলজি পরীক্ষার ফি, সেবার মূল্য তালিকা এবং চিকিৎসকের চিকিৎসা ফির তালিকা প্রকাশ্য স্থানে টাঙানোর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বিএমডিসিকে এ আদেশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হলেও তা’ বাস্তবায়িত হয়নি। গত ২২ অক্টোবর আরেকবার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
এই কমিটিকে আগামী দুই মাসের মধ্যে চিকিৎসা ফি সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। অধিদফতর জানায়, ২০০৯ সালের এ আইন সংশোধন হলে রক্ত, মল-মূত্র পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এমআরআই, এনজিওগ্রাম, ইসিজি ও ইটিটি পরীক্ষার মূল্য তালিকা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘সহজে দৃশ্যমান স্থানে’ প্রদর্শন করতে হবে। বর্তমানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে বিভিন্ন ‘সেবা’র মূল্য তালিকা প্রদর্শনের কথা বলা হলেও তা’ নির্দিষ্ট করা ছিল না।
এদিকে, রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ শত শত বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে ওসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান লালন করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। র্যাব সদস্যের অভিযান প্রশংসিত হলেও ঘন ঘন অভিযান চালানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে দেশজুড়ে অবৈধ ওইসব সেন্টারের ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে।
একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। সরলতার সুযোগ নিয়ে এসব ক্লিনিকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী দিনের পর দিন রোগীদের ঠকিয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে।
অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে কিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারি ফি বেসরকারি হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেকগুণ কম। সরকারি হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্স-রে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সব হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।
এই মুহূর্তে কোন ঘাটতি নেই। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ৫ হাজার টাকা।
এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্স-রে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে ৪৫০ টাকা। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নিম্নমানের হাসপাতাল।
আমরা মনে করি, প্যাথলজি ফি ও ডাক্তারি পরীক্ষার মূল্য তালিকা প্রদর্শন কার্যকর করার ক্ষেত্রে তদারকী ব্যবস্থার দুর্বলতা রয়েছে। অনেক ভালো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার সরকারের সকল প্রকার ফি, ট্যাক্স যথাযথভাবে দিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক ক্লিনিক আছে তাদের না আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, না আছে অভিজ্ঞ প্যাথলজিষ্ট বা আধুনিক যন্ত্রপাতি। ফলে তারা লাভ করছে বেশি। তাই এ ক্ষেত্রে তদারকী দরকার। তা না হলে এ ক্ষেত্রে অনিয়ম চলতেই থাকবে। মূল্য তালিকা কার্যকর হবে না।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply