
বেশি দিন নয়। ক’দিন আগের কথা। ভাই, ভাবি, ভাতিজি ও স্ত্রীকে নিয়ে নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন মেহেদী। উঠেছিলেন ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে। নেপাল পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়।
ওই দুর্ঘটনায় বিমানের ৬৭ যাত্রীর মধ্যে ৫০ জনের মৃত্যু হয়। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনিসহ স্ত্রী সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি। তবে চোখের সামনে আগুনে পুড়ে মারা যান তাঁর ফুফাতো ভাই এফ এইচ প্রিয়ক ও প্রিয়কের শিশুকন্যা তামারা প্রিয়ন্ময়ী। মেহেদীকে উদ্ধার করে কাঠমাণ্ডু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে গত ১৬ মার্চ দেশে ফিরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
গতকাল চিকিৎসকদের বলে আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন নিহতদের জানাজায় অংশ নিতে। স্টেডিয়ামের প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ডান দিক ও বাম দিকের গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল নিহতদের স্বজনদের। গতকাল বিকেল পৌনে ৩টা থেকে স্বজনরা সেখানে প্রবেশ করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্যালারি ভরে যায়। শুরু হয় গগনবিদারি কান্নার রোল। পুরো স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে শোকের নিকষ পাথর। ডান দিকের গ্যালারির নিচে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিলেন মেহেদী। গলায় কলারবন লাগানো। গায়ে চাদর। মাথা ন্যাড়া। দুই হাত আর পায়ে দুর্ঘটনার ক্ষত। চোখ বেয়ে অঝোরে নামছিল অশ্রুধারা।
মেহেদী হাসানের কাছে দুর্ঘটনার দিনের কথা জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, বিমানের পেছনের দিকের আটটি সিটের আগে ১৪ ডি নম্বর সিটে তিনি বসেছিলেন। সঙ্গে স্ত্রী, ভাই প্রিয়ক, ভাবি অ্যানি, ভাতিজি প্রিয়ন্ময়ী। তাঁর সামনে ছিল ১৩-১৪টি সিট। জীবনে প্রথম তিনি বিমানে চড়েছেন। দুর্ঘটনার আগে বিমানটি ৪৫ মিনিটের মতো আকাশে চক্কর দেয়। কখনো নিচের দিকে নামে তো আবার ওপরে উঠে যায়। একপর্যায়ে বিমানটি কাত হয়ে যায়। তারপর প্রচণ্ড শব্দ করে বিমানটি মাটিতে নামে। বিমানটি যখন আকাশে চক্কর দিচ্ছিল।
তখনো যাত্রীদের মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়নি। মেহেদী বলেন, ‘পাশে বসা আমার স্ত্রী বলে, ল্যান্ডিংটা এমন হলো কেন? কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম বিমান ক্রাশ করেছে। আমার পায়ের নিচের দিকে ধোঁয়া উড়তে শুরু করে। আমার স্ত্রী বলতে থাকে সে পুড়ে মরতে চায় না। সিটবেল্ট দিয়ে জানালা ভাঙার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। বিমানের ভেতরে অন্ধকার হয়ে যায়। একপর্যায়ে বিমানের সামনের দিকে বাইরের আলো দেখতে পাই। সেখান দিয়ে কিভাবে যে বাইরে বেরিয়ে এসেছি, এখন আর মনে করতে পারছি না। বাইরে বেরিয়ে দেখি বিমানের সামনের অংশ ভেঙে গেছে। পেছনের দিকে আগুন জ্বলছে।
মনে পড়ে অন্যদের কথা। আবার বিমানের ভেতরে প্রবেশ করে আমার স্ত্রীকে ডাকতে থাকি। তাকে টেনে বের করে আনি। ভেতরে প্রবেশ করে বুঝতে পারি বিমানের ছাদটা নিচু হয়ে গেছে। পরে বাইরে এসে দেখি বিমানের ভেতরে ফায়ারিং হচ্ছে। আর প্রবেশ করতে পারিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন লেগে যায় পুরো বিমানে। আহত যাঁরা তাঁরা আগেই বিমানের ভাঙা অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মেহেদী বলেন, ‘আমার যেটুকু মনে আছে, বাইরে বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর আগুন জ্বলতে শুরু করে। ৭-৮ মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর নেপাল সেনাবাহিনীর লোকজন আসে। আমার যে শরীর কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে তাও টের পাচ্ছিলাম না।
মেহেদী হাসান আরো জানান, বিমানটি খুবই জোরে মাটিতে ছিটকে পড়ে। ফলে সিটবেল্ট ছিঁড়ে অনেকে সামনের সিটে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারায়। অনেকে দুই সিটের ফাঁকে আটকে যায়। ফলে তারা বের হতে পারেনি। মিনিট দেড়েক পরে যখন আগুন লেগে যায়, সেই আগুনে তাদের মৃত্যু হয়। এ সময় অনেকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। কথাগুলো বলতে বলতে নির্বাক হয়ে পড়েন তিনি। শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকেন।
এ তো গেলো একজনের গল্প। এমন আরো অনেক মেহেদীর গল্প যে অজানাই রয়ে যাবে, তাঁরা যে শায়িত রয়েছেন চিরনিদ্রায়।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply