
রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার একর বন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। এছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ক্ষতি সত্বেও স্হানীয়দের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও বন বিভাগের বাধা উপেক্ষা করে উখিয়ার রিজার্ভ ফরেস্টে কয়েক শত একর জুড়ে বন-বাদার ধ্বংস করে আরও একটি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্হাপনের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বন বিভাগ।
এরই মধ্যে গড়ে তোলা ৩২ টি ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গার সংকুলান হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশী ও বিদেশি এনজিওগুলোর স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে বেশি তৎপর বলে জানান উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি এম এ মন্জুর।
উখিয়া বন রেঞ্জর পালংখালীর মোছার খোলা টহল ফাঁড়ির চৌখালী রক্ষিত বনের ১শ একর সৃজিত আগর বাগান জবর দখল করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর অর্থায়নে এনজিও ব্রাক নতুন আরও একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্হাপন কাজ শুরু করেছে।

মোছার খোলা বন টহল ফাঁড়ির ইনচার্জ ফরেস্টার দেলোয়ার হোসেন জানান, চৌখালী রিজার্ভ ফরেস্ট যেখানে ২০১০-২০১১ অর্থ সালে ১শ একর আগর বাগান সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেখানে নতুন আরেকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
বন-বাদারে গাছ ও পাহাড় কাটার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এনজিও লোকজন বলেছে, তারা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারসহ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে কাজ করছে। বন কর্মী হিসেবে বনজ সম্পদ রক্ষায় বাঁধা প্রদান করলে তা তারা না মেনে বোল্ড ডোজার ও অসংখ্য রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় আগর বাগানের অংশীদার মো. সেলিম জানান, সরকার যেখানে এখানকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোসহ ভাষান চরে স্থানান্তরের জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সেখানে ৩২টি ক্যাম্প থাকার পরও আরও একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপন মানে স্থানীয় লোকজনদের পথের ভিখারী বানানো।
অপর অংশীদার আবুল কালাম জানান, তাদের সর্বস্ব এ আগর বাগানে বিনিয়োগ করেছেন। কায়িক শ্রম দিয়ে গড়ে তোলা এই বাগানের কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে ধ্বংস করার অর্থ এদেশে স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গাদের অনেক মূল্য। তা না হলে সরকারি কর্মকর্তারা এভাবে তাদের রুজি রুটি কেড়ে নিতো না।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের জন্য এসব ক্যাম্প স্থাপনে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ২ হাজার ২৭ একর সৃষ্ট বন (প্রধানত সামাজিক বনায়ন) এবং ৪ হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বনধ্বংস হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ জন রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে।
রোহিঙ্গাদের আরামদায়ক আবাসস্থল তৈরীর জন্য জাতিসংঘ সহ দেশী-বিদেশি এনজিওগুলোর স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকজনদের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে তুলছে বলে অভিযোগ উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীসহ সচেতন মহলের।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে ৬ হাজার একর বন ভূমিতে প্রায় ৯ লক্ষ রোহিঙ্গা অবস্থান করলেও আরও আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গার আবাসস্থলের তথ্য অগোচরে রয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের চর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, খাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি ও অকৃষি জমিসহ আরও ২ হাজার একর ভূমিতে এরা অবস্থান করছে বলে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন।
বন বিভাগ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে গত মাসে একটি চিঠি সহকারে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গা বসতির কারণে বনভূমির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বন বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের ৬ হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী দেয়া হলেও রান্নার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে খুবই কম। ফলে প্রতিদিনই তারা পাশ্ববর্তী সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করছে। এতে গত ১৯ মাসে রোহিঙ্গারা জ্বালানি কাঠ হিসেবে রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ পুড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন।
পাহাড় কেটে অহরহ মাটি ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। উখিয়ায় ২৪ টি ও টেকনাফে ৬ টি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুনভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির গড়ে তোলা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় ২টি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির রয়েছে। জানা গেছে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় শিবির গুলোতে বেশ কিছু অবকাঠামো তৈরি করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বনভূমি ও বনজ সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরে গেলেও জায়গা জবরদখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থাপনাগুলো অপসারণ করে বনায়ন করা কঠিন হবে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply