
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে। তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় হত্যা করা হয় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি কে।
পিলখানার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সদস্যদের নিয়ে একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়। পিলখানার ঘটনার পেছনে প্রকৃত সত্য বের করার জন্য তদন্ত দল টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও জেরা করতে চেয়েছিল বলে জানা যায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিকসের তথ্য হতে। তদন্ত দলটির এই প্রস্তাব শোনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির সাথে ২০০৯ সালে ২৭ এপ্রিল প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সাক্ষাত করেন এবং সাক্ষাতের এক পর্যায়ে তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে এই তথ্য প্রকাশ করেন।
গত বছরের ৩০ আগস্ট উইকিলিকস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব গোপন কূটনৈতিক তারবার্তা প্রকাশ করেন তার মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
২০০৯ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ২০ সদস্যদের একটি তদন্ত দল গঠন করা হলেও তাদের তদন্তের সীমাবদ্ধতা ছিল বিদ্রোহে হারানো অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংখ্যা বের করা। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সরকারও একটি তদন্ত দল গঠন করে এই ঘটনার রহস্য খুজে বের করার জন্য। কিন্তু সেনাবাহিনীর তদন্ত দল টি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েক জন সদস্য কে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান।
সেনাবাহিনীর তদন্ত দলটির প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। উইকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি জানান, সেনাবাহিনীর আলাদা ভাবে তদন্তের বিষয়ে শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,কিভাবে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তারা চিঠি পাঠান। এ কাজ তাদের নয়, এ কাজ পুলিশের। শেখ হাসিনা ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।
সেদিনের সেই বৈঠকে শেখ হাসিনা জেমস এফ মরিয়ার্টি কে আরো বলেন,তার দলের বেশ কয়েকজন নেতা কে বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ করার জন্য বিডিআর সদস্যদের চাপ দিচ্ছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঐ বেঠকে হাসিনা ও জেমস এফ মরিয়ার্টি উভয়ে সামরিক ও বেসামরিক সম্পর্ক কে জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো অপর একটি তারবার্তায় বলেন, মন্ত্রিসভার নিষেধ সত্ত্বেও বিডিআর বিদ্রোহের পর ১লা মার্চ শেখ হাসিনা সেনা সদর দপ্তরে যান। সেখানে তিনি প্রায় ৫০০ ক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তার মুখোমুখি হন। তার দলের নেতারা আশঙ্কা করেছিলেন সেনানিবাসে গেলে হাসিনার প্রাণনাশ হতে পারে। এরপর শেখ হাসিনা আড়াই ঘন্টার বৈঠক শেষে যখন নিরাপদে বের হয়ে আসেন তখন অনেকে বিষ্ময় প্রকাশ করেন।
সেদিন ই মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) তারেক আহমেদ সিদ্দিকীর বরাত দিয়ে একটি তারবার্তা পাঠান। উক্ত তারবার্তার তিনি বলেন,” পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ সেনাকর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন।”
সেদিনের সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) তারেক আহমেদ সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।
মরিয়ার্টি তারবার্তায় বলেন,” শেখ হাসিনা তীব্র ক্ষোভের মুখোমুখি হন এবং অনেক সেনাকর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে কটূক্তি করেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী অনেক সেনা কর্মকর্তা সেদিন চিৎকার করে বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ঐ বৈঠকে তারেক আহমেদ সিদ্দিকী আওয়ামী কট্টর বিরোধী কিছু সেনা কর্মকর্তা কে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তবে বৈঠক টি শান্তিপূর্ণ ভাবে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের জন্য মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়।
ঐ বেঠকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল না তবে না মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানতে পেরেছিলেন,সেনা কর্মকর্তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা পিলখানার ঘটনার দিন মধ্যস্থতাকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এর পদত্যাগ দাবি করেন।
অনেক সেনা কর্মকর্তা বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত জওয়ানদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার দাবি করেন।
তবে হাসিনার সেদিন ঐ বেঠক থেকে জীবিত ফিরে আসার ঘটনা কে অনেকের কাছে বিষ্ময়কর ছিল, কারন অনেক সেনা কর্মকর্তা বিশ্বাস করেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী সেনা অভিযানের নির্দেশ না দেওয়ার জন্য ই এত বড় সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল তারা।
সেনাবাহিনী তখন এটাও মনে করেছে যে, সরকার বিডিআর সদস্যদের দাবি -দাওয়া না মেটানোর কারনে তারা প্রতিশোধ নিয়েছে এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে।
এই সকল কারনে সেনা বাহিনীর ভিতরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি ক্ষোভ জমা হয়েছিল কিন্তু শেখ হাসিনা সেটি বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন।
Leave a Reply