
নেলসন মেন্ডেলা বলেছিলেন “আজকের তরুণরাই আগামীকাল নেতৃত্ব দিবে”, বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের পরিস্থিতি বলছে, আজকের তরুণরা আজকেও নেতৃত্ব দিচ্ছে, ভবিষ্যতেও দিবে। আমরা যদি উপমহাদেশের আন্দোলনগুলো পর্যালোচনা করি তাতে দেখতে পাবো তরুণদের হাত ধরেই বেশীর ভাগ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম নেতা, রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক ‘মহাত্মা গান্ধী’ মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৮৯৪ সালে গান্ধী নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করেন। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতে এক সংক্ষিপ্ত সফর শেষে ফিরে আসার পর এক শ্বেতাঙ্গ মব তাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। গান্ধী এই মব সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি। কারণ তার মতে, কারও ব্যক্তিগত ভুলের জন্য পুরো দলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়াকে তিনি সমর্থন করেন না।এই তরুণ বয়সে তার অসাধারণ নেতৃত্বের গুণ ফুটে ঊঠেছিলো। আর এই তরুণ নেতা গান্ধীই কিন্তু একটা সময় এসে ভারতীয় উপমহাদেশ কে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তরুণ নেতৃত্বের কথা যখনই আসে তখন শিক্ষার্থীদের বিষয়টাও ওতপ্রোত ভাবে চলে আসে। কারন ইতিহাস বলে শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই তরুণ নেতৃত্বের মূল প্রকাশ পায়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চলের সকল আন্দোলন এর নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা। এমনকি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আন্দোলন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৯০ এ গণতন্ত্রের আন্দোলন, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে শুরু করে ছোটখাটো সকল আন্দোলন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বাংলার সকল শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে তথা তরুণ প্রজন্মের মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে বিশ্ব তথা বাংলাদেশের নেতৃত্ব স্থানে যাদেরকেই আমরা দেখি না কেন, তাদের ইতিহাস বলছে ছাত্রজীবনেই তাদের নেতৃত্ব চর্চা বর্তমানে তাদের এই অবস্থানে এনে দিয়েছেন। অর্থাৎ নেতৃত্ব চর্চার সময়টাই হচ্ছে তরুণ বয়েসে। এজন্যই হয়তো কবিরাও এই তরুণ বয়সকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন “যৌবন হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি, যা আমাদের জীবনকে করে তুলে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। যৌবন শক্তিকে কবি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন সমস্তজীর্ণ পুরোনো সংস্কারকে ধবংস করে মনের মত নতুন জগত রচনার সাধনায় অগ্রসরহতে। ইতিহাসে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরণের নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়েছে। রাজা বাদশাদের শাসনামলে সে ব্যক্তিই ছিলো নেতা যে কিনা একা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ১০ জন সৈন্যকে ঘায়েল করে। অথবা, একের পর পর এক রাজ্য জয় করে নিজের রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করে। এর পর আমরা দেখেছি পরপর ২ টা বিশ্বযুদ্ধ। অস্ত্রের মুখে নেতৃত্বের চর্চার একটা অন্যরকম বিশ্ব ছিলো সেই সময়কালে। পরবর্তীতে সময় আসলো ব্যাবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে নেতৃত্ব চর্চা। প্রতিষ্ঠিত হলো বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মত বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠন। অন্যরকম এক নেতৃত্বের হাত ধরে এগুতে থাকলো বিশ্ব।
বর্তমানে এর প্রভাব অনেক বেশী আছে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এখন তারাই বেশি শক্তিশালী যারা ব্যবসা বানিজ্যে বেশি এগিয়ে। অস্ত্র প্রস্তুতকারক দেশগুলো অস্ত্রের মুখে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখছেন না, তারা এই অস্ত্র দিয়ে বানিজ্য করে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখছে। ইন্টারনেটে যখন আমি তরুণ নেতা দের নিয়ে জানতে বসবেন দেখবেন যে কজন মানুষ সম্পর্কে ইন্টারনেট আপনাকে তথ্য দিচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছেন “মার্ক জুকারবার্গ”। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিলিয়নিয়ার হন। যা ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে বিলিয়নিয়ার হওয়ার একটি রেকর্ড। বর্তমানে মার্ক জুকারবার্গ এর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে ৬ নম্বরে রয়েছেন। বর্তমানে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এই তরুন উদোক্তা বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছেন।বর্তমান সময়ে প্রেক্ষাপট এর সাথে সাথে নেতৃত্ব চর্চার ধরণটাও পরিবর্তন হয়েছে। আমরা তরুণা নিজ নিজ জায়গা থেকে যে কাজই করি না কেন, তাতে যদি দেশের বা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে তবেই হবে আমাদের তরুণদের নেতৃত্ব চর্চা! কেউ বা একটা আইটি ফার্ম চালাচ্ছেন, কেউ একটা ছোট খাটো ব্যসায় প্রতিষ্ঠান
চালাচ্ছেন, কেউ বা কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন, কেউ রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্র রাজনীতি করছেন, যে যেখানেই যাই করছেন শুধু দেখতে হবে আপনার কাজের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে কিনা। এ জন্য অনেক তরুণ নেতা তাদের লিডার শব্দটার চেয়ে চ্যাঞ্জমেকার শব্দটা ব্যবহারে বেশি আগ্রহী থাকেন। আপনি যদি নিজের জায়গা থেকে সমাজের কোনো পরিবর্তন নাও করতে পারেন, অন্ততপক্ষে এমন কিছু করবেন না যাতে করে আপনার ঐ কাজের মাধ্যমে দেশ পিছিয়ে যায়। এটাই হবে আপনার নেতৃত্ব চর্চার প্রথম ধাপ। মনে রাখবেন ঝালমুড়ি খেয়ে প্যাকেট টা রাস্তায় ফেলে দিলেন, অযথা লাইট ফ্যান চালু রাখলেন, ম্যাচের কাঠি বাঁচাতে গিয়ে চুলা জালিয়ে গ্যাস অপচয় করলেন। এর প্রতিটা কাজ দেশ কে একটু করে পিছিয়ে দিচ্ছে। চিন্তা করুন ১৮ কোটি মানুষ যখন এই কাজ গুলো করে তখন একটু একটু করে দেশ কতটা পিছিয়ে যাচ্ছে! আমরা ৩ কোটি ২০ লক্ষ তরুণ আমাদের আমাদের নেতৃত্ব চর্চাটা ১৮ কোটি মানুষকে এই কাজ গুলো থেকে বিরত রাখার মাধ্যমেই শুরু করি! দেখবো দেশ কতটা এগিয়ে যাচ্ছে! আমরা তরুণরা যে যেখানেই যেভাবেই থাকি না কেন নেতৃত্ব চর্চাটা করা খুব সহজ। রাস্তায় যখন দেখবো কোনো নারীর উপর যেকোনো ধরনের হয়রানি হচ্ছে, আমরা বাধা দিবো। কোনো বয়স্ক লোক বাসে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দিবো, আমাদের সামনে ছোট বড় কোনো দূর্নীতি দেখলে আমরা বাঁধা দিবো। এগুলোই তো আমাদের নেতৃত্ব চর্চার অন্যতম মাধ্যম। সংসদে গিয়ে কথা না বললে, বা মঞ্চে না দাঁড়ালে যে নেতৃত্ব চর্চা করা যাবে না এমনটা না।
লেখকঃ
এস, এম, আশেক উল্লাহ সোপান
কেন্দ্রীয় সভাপতি,
বাংলাদেশ স্টুডেন্ট কাউন্সিল।
শিক্ষার্থী,
ইন্টারন্যাশনাল বিজিনেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইলঃ asheqshopan@gmail.com
Leave a Reply