
সয়াবিন তেল কোম্পানি এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে জাল লেটার অব ক্রেডিটের (এলসি) মাধ্যমে মোস্তফা গ্রুপ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) ১৭৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। কমিশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী, এ অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে এম এম ভেজিটেবলের সাত কর্মকর্তা, বিডিবিএলের দুই কর্মকর্তা ও সহযোগী দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ১১ জন জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান অনুসন্ধান শেষে তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চেয়ে কমিশনে নথি উত্থাপন করেছেন। কমিশনের বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা দায়ের করা হবে আজ সোমবার।
এ বিষয়ে গুলশান আনোয়ার প্রধান গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কমিশন থেকে মামলার অনুমোদন সংক্রান্ত নথি বুঝে পেয়েছি। বিডিবিএলের ১৭৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১১ জনকে আসামি করে আজ সোমবার সমন্বিত জেলা কার্যালয় (সজেকা) ঢাকা-১-এ মামলা দায়ের করা হবে।’
দুদকে পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) প্রতিবেদনে অনুযায়ী, চট্টগ্রামের মোস্তফা গ্রুপ তাদের ৩১ প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ফান্ডেড (নগদ) এক হাজার ৪১৩ কোটি এবং নন-ফান্ডেড (ব্যাংক গ্যারান্টি) ১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি ৪৩৫ কোটি টাকা এবং অবলোপন করা হয়েছে ২০০ কোটি ৮১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কুঋণ ৪০৭ কোটি টাকা। এলসি জালিয়াতিসহ বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রায় পুরোটাই অনাদায়ী রয়ে গেছে। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত জামানতও নেই।
মোস্তফা গ্রুপ ঋণের টাকা ব্যবসায় না লাগিয়ে অন্য কাজে লাগিয়েছে কিংবা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে যে ৮৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে বিডিবিএলের কাছ থেকে জাল এলসির নামে নেওয়া ঋণও রয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেড বিডিবিএলের ১৭৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বড় ধরনের এ জালিয়াতির সঙ্গে বিডিবিএলের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত। প্রাথমিক অনুসন্ধান অনুযায়ী এই অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ও এম এম ভেজিটেবলের চেয়ারম্যান হেফাজেতুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহির উদ্দিন, বিডিবিএলের মতিঝিল প্রিন্সিপাল শাখার সাবেক এসপিও (জ্যেষ্ঠ প্রধান কর্মকর্তা) দীনেশ চন্দ্র সাহা, প্রিন্সিপাল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক সৈয়দ নুরুর রহমান কাদরী, এম এম ভেজিটেবলের পরিচালক কামাল উদ্দিন, কফিল উদ্দিন, রফিক উদ্দিন, শফিক উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন, লুডিসা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন চৌধুরী এবং মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুল আলম চৌধুরী।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে স্থাপিত এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেড মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডট্রিজের সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল রিফাইনারি প্ল্যান্ট। এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস অ্যাট সাইট এলসি (৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হয় এমন এলসি দাবি) দেয় মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল ও লুসিডা ট্রেডিং নামের কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠান দুটি মোস্তফা গ্রুপেরই সৃষ্ট কাগুজে প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালের ২১ জুন মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল ৫৪ কোটি ৩১ লাখ ৮৮ হাজার ১০০ টাকার ও লুসিডা ট্রেডিংয়ের ২৫ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার ৩২০ টাকা মূল্যের দুটি এলসি এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস থেকে পাওয়ার রেকর্ডপত্রে দেখানো হয়। মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল ও লুসিডা ট্রেডিং এলসির শর্ত অনুসারে মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে বলে এমএম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টসের নির্ধারিত ব্যাংক বিডিবিএলকে জানায়। বিডিবিএলের প্রধান (প্রিন্সিপাল) শাখা এম এম ভেজিটেবল ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল বুঝে পেয়েছে কি না সেটা নিশ্চিত হয়নি। তারা শুধু এম এম ভেজিটেবলের নামে পাঠানো নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করেই এলসির গ্রহণযোগ্যতা (একসেপটেন্স) দিয়ে দেয়। মেসার্স গ্লোব ইন্টারন্যাশনাল ও লুসিডা ট্রেডিং নামে বাস্তবে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই ছিল না। ভুয়া রেকর্ডপত্রাদি তৈরি করে মালামাল প্রদান এবং গ্রহণ দেখিয়ে বিডিবিএল থেকে ট্রাস্ট ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকে এলসিতে উল্লিখিত পরিমাণ টাকা স্থানান্তর করে। এম এম ভেজিটেবল কর্র্তৃপক্ষ ওই টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে।
দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং নিজেরা লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে জাল নথিপত্র জেনেও বিডিবিএল সেটা গ্রহণ করে। এর ফলে বিডিবিএল থেকে ৭৯ কোটি ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৪২০ টাকা ট্রাস্ট ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকে স্থানান্তর হয়েছে। পরে এম এম ভেজিটেবল অয়েল কর্র্তৃপক্ষ সেটা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করে, যা বর্তমানে সুদে-আসলে ১৭৪ কোটি টাকা।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি:/আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply