
একসময় নাটোরের নারদ নদ ছিল খরস্রোতা। দখল আর দূষণে আজ সেই নদ মৃতপ্রায়।জালের মতো বিস্তার ছড়িয়ে দেশের দেহে প্রাণের সঞ্চার করে নদী। নদীপ্রবাহের তীরে গড়ে ওঠে সভ্যতা। বিলুপ্তও হয়। একসময় দেশের প্রায় সব কটি নদী প্রচণ্ড খরস্রোতা ছিল। নদীপ্রবাহে ছিল না মানবসৃষ্ট কোনো প্রতিবন্ধকতা। প্রকৃতির নিয়মে নদীগুলো বয়ে চলত আপন স্বভাবে। তেমনই এক নদী নাটোরের নারদ নদ। একসময় এই নদও ছিল খরস্রোতা। মানুষের নির্যাতন, নিষ্ঠুরতায় খরস্রোতা নদটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য, দখল, ভরাটের কারণে নারদ নদ বর্তমানে পরিণত হয়েছে সরু খালে।
অন্যদিকে নদটি খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। খননের মাটি পারে ফেলে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বহু অবৈধ স্থাপনা। কলকারখানার দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে নদের পারের মানুষদের জীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় নদ সংস্কার, অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং দূষিত বর্জ্য ফেলা বন্ধের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে নাটোরবাসী। টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটির উদ্যোগে এবং বিভিন্ন সংগঠন ও সচেতন নাটোরবাসী দুই বছর ধরে নারদ নদ বাঁচাতে আন্দোলন করে আসছে। সর্বশেষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বড়াল নদ ও বড়াল নদ সংলগ্ন নদীগুলো সংস্কারের ঘোষণা দিলেও এখনো আশ্বস্ত হতে পারেনি নাটোরবাসী।
সূত্র মতে, নারদ নদ ঘিরে প্রায় ৩০০ বছর আগে নাটোর শহরের গোড়াপত্তন হয়। ১৭০৬ সালে নাটোরের রাজা রামজীবন ও রঘুনাথ এখানে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলার তখনকার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নাটোরের যোগাযোগ। তখন খরস্রোতা এই নারদ নদই ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল। ধীরে ধীরে এর দুই তীরে গড়ে ওঠে বসতি। নারদের উর্বর জমি সেখানে বসতি গড়ে তুলতে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। নারদের স্বচ্ছ পানি ও নির্মল বায়ু দুই পারের মানুষের স্বাস্থ্যকর বসবাস নিশ্চিত করে।
‘নারদ নদ’ বইয়ের লেখক মাহবুব সিদ্দিকী ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে নিশ্চিত হয়েছেন নারদ বাংলাদেশের প্রাচীনতম নদের একটি। এর তীরে নাটোর শহর থেকে একসময় রাজশাহী অঞ্চলের শাসনকাজ নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৮২১ সালে পদ্মা নদীতে বন্যায় ব্যাপক জলস্ফীতি হলে উৎসমুখে বালু ও পলি জমে নারদ স্রোতহীন হয়ে পড়ে। সেবারের বন্যায় দীর্ঘদিন নাটোর জলাবদ্ধ ছিল। তাই রাজশাহী অঞ্চলের সদর দপ্তর নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৮২৫ সালে তা স্থানান্তর শেষ হয়।
১৮২১ সাল থেকে নারদ নদের রাজশাহী অঞ্চলের পানিপ্রবাহ মরে যেতে থাকে। তবে নাটোর অঞ্চলের নারদ নদে পদ্মার পানি রাজশাহীর চারঘাট হয়ে বড়াল ও মুসাখান প্রবাহ দিয়ে ঢুকছিল। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদের জন্ম হয়। বড়াল থেকে জন্ম হয় মুসাখান নদ। নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়ায় মুসাখান নদ থেকে নারদ আবার পদ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে নারদ মৃত নদে পরিণত হতে শুরু করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় নদের তীর ভরাট করে শুরু হয় দখলপ্রক্রিয়া। গড়ে তোলা হয় স্থায়ী ও অস্থায়ী অবকাঠামো। ফলে কমতে থাকে নদের আয়তন।
নাটোর শহরের কানাইখালী মহল্লার বাসিন্দা লেখক গবেষক খালিদ বিন জালাল বাচ্চু বলেন, ‘নাটোর সুগারমিল, যমুনা ডিস্টিলারিজ ও প্রাণ অ্যাগ্রো কারখানার দূষিত বর্জ্য ফেলা হয় নারদ নদে। ফলে এর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ে। ওই দূষিত বর্জ্যের দুর্গন্ধে নদপাড়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নদের দূষিত স্রোতহীন পানি মশা-মাছি উৎপাদনের খামারে পরিণত হয়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডির দেওয়া তথ্য মতে, সদর উপজেলার হাশিমপুর, সাধুপাড়া, মোহনপুর, পীরগঞ্জ ও কসবা গ্রামে নারদের ওপর ছোট ছোট কালভার্ট রয়েছে। কোনোটির নিচ দিয়েই পানি চলাচল করতে পারে না। সদর উপজেলার কাফুরিয়া ইউনিয়নের লোটাবাড়িয়া গ্রামে নারদের ওপর মাটি ফেলে রাস্তা নির্মাণ করেছে স্থানীয় লোকজন। নারদে পানি প্রবেশের পথে চারঘাটে স্লুইস গেটের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি প্রতিবন্ধক রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পকেটখালী এলাকায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের একটি ব্রিজ ও পীরগাছা এলাকায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি ক্রস ওয়াল (নদীবেষ্টনী বাঁধ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটিই পড়েছে মুসাখান নদীর ওপর। তবে মুসাখানের ওই প্রবাহ ধরেই নারদে পানি প্রবেশ করে।
নাটোর শহরবাসী জানায়, ১৯৯০ সালের দিকে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান আমিনুল হক গেদু নাটোর চিনিকল ও যমুনা ডিস্ট্রিলারিজের বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। পরে আদালতে একটি মামলাও হয়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ওই উদ্যোগ থেমে যায়। এর বেশ পরে কয়েকটি সংগঠন এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেও তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে সর্বশেষ নারদের বিষয়ে হাইকোর্টে রিট করে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা। ওই মামলার রায়ে আদালত অবিলম্বে সব দখল ও স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দিলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি।
এদিকে জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ‘বড়াল বেসিন প্রকল্প’ নামে নারদ নদ খননকাজ শুরু করে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০০৪-০৫ অর্থবছরে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নারদ খননের জোরালো দাবি ওঠে। ওই দাবির ফলে নারদ নদ, মুসাখান নদী (অংশবিশেষ) এবং চারঘাট স্লুইস গেটের ইনটেক চ্যানেল পুনঃখনন প্রকল্প অনুমোদন পায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশু কুমার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৮-০৯ থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরে তিন দফায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। নারদ খননে কাগজে-কলমে ঠিকাদার ছিল নাটোর পৌরসভার মেয়র ও পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ ইমদাদুল হক আল মামুন, রাজশাহীর আবুল হোসেন ও ঢাকার ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ওই ঠিকাদারদের কেউই সরাসরি কাজ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা খননকাজ করেন। এ সময় খননের নামে উল্টো কিছু স্থানে নদের উপরিভাগে মাটি ফেলা হয়। এ সুযোগে প্রভাবশালীরা নদের জায়গা দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলে। আর ছিন্নমূল মানুষেরা গড়ে তোলে বস্তি। বর্তমানে শহরের মধ্যে নারদ নদের দুই তীরে কোথাও সামান্য ফাঁকা স্থান নেই। সবটাই দখল হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশু কুমার জানান, নারদ নদ পুনঃখননের জন্য একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে নারদে পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, ‘নারদ খনন এবং পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ড, আইডাব্লিএম, নদী কমিশমনসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে মতবিনিময়সভা করা হয়েছে। নারদ নদ সংস্কার এবং দখল উচ্ছেদে সবাই একমত। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে সাড়াও পাওয়া গেছে। নাটোর পৌর এলাকার ছয় কিলোমিটার নারদ নদের মধ্যে দখলদারদের তালিকা ইতিমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। আশা করছি আগামী শুষ্ক মৌসুমেই নারদ নদ সংস্কারের কাজ শুরু হবে। সে সময় দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।’
নারদ নদ রক্ষা আন্দোলন : নারদ নদের দখল উচ্ছেদ, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা, পরিকল্পিত খনন ও সংস্কার এবং রাজশাহীর চারঘাটের স্লুইস গেট অপসারণ করে নদে পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে মানববন্ধন ও সভা-সামবেশ করা হয়েছে। টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটির ব্যানারে এসব আয়োজনে নাটোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান, নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরীসহ নাটোরের সচেতন নাগরিক ও ৪২টি সংগঠন সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং নাটোর সদর উপজেলা পরিষদ ও নাটোর পৌরসভার উদ্যোগে নারদ নদের বিভিন্ন অংশ পরিষ্কার করা হয়েছে। আন্দোলনরত নেতারা বলছেন, নারদ নদ সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার বিন কবির সম্প্রতি নাটোর গণভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নারদ নদ খনন আগামী শুষ্ক মৌসুমে শুরু করা হবে। কোনো ধরনের বাধা এলে তা গুঁড়িয়ে দখল উচ্ছেদ করে নারদ নদ বাঁচানো হবে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডিঃ/ আমিরুল ইসলাম
Leave a Reply