
অবশেষে ঐতিহাসিক মুহূর্তটি এল। বহু অপেক্ষার পর ঘড়িতে সময় হলো ২টা ১৪ মিনিট। তারপরই যেন রচিত হল মহাকাব্য। মহা গৌরবের ইতিহাস লেখা হয়ে গেলো।
তীব্র আগুনের হলকা ছুটিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে মহাকাশের পথে ডানা মেলল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এর মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে যুক্ত হলো বাংলাদেশের নাম। বাস্তব রূপ পেল দীর্ঘদিনের এক স্বপ্ন।
স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের পরপরই সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মহাকাশে আজ উড়ল বাংলাদেশের পতাকা। আজ থেকে আমরাও স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হলাম।’ ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে হাজির ছিলেন অনেক বাঙালি। তাঁদের কেউ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী, আবার কেউ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল।
গত বৃহস্পতিবার মহাকাশে যাওয়ার একেবারে খুব কাছে এসে শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ। কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে উৎক্ষেপণ হওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ১ মিনিট আগে ৩টা ৪৬ মিনিটে এসে থেমে যায় আয়োজন।
স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সম্ভাব্য ‘সামান্য’ কারিগরি ত্রুটির আশঙ্কা থাকায় উড়ছে না বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। এরপর আবার সময় নির্ধারণ করা হয়, পরের রাতের ২ টা ১৪ মিনিটে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়াটি দুভাবে সম্পন্ন হবে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো উৎক্ষেপণ ও নির্দিষ্ট কক্ষপথে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায় পেরোনো। এই প্রক্রিয়ার জন্য সময় লাগবে ১০ দিন, যেটি গতকাল শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে কক্ষপথের নির্দিষ্ট স্থানে জায়গা করে নেবে স্যাটেলাইটটি। এ জন্য সময় লাগবে ২০ দিন।
সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপিত হতে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের কমপক্ষে এক মাস সময় লাগবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বহনকারী ফ্যালকন-৯ রকেটের চারটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে থাকবে স্যাটেলাইট এবং এরপর অ্যাডাপ্টর। অ্যাডাপ্টরের নিচের অংশটিকে বলা হয় স্টেজ-২ এবং রকেটের শেষের অংশকে বলা হয় স্টেজ-১। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-১ খসে পড়বে এবং এটি পৃথিবীর দিকে ফিরে আসবে। এরপর রকেটের স্টেজ-২ স্যাটেলাইটটিকে কক্ষপথের দিকে নিয়ে যাবে। স্যাটেলাইটটি কার্যকর হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ যাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ায় অবস্থিত তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে। এই তিনটি স্টেশনের মাধ্যমে স্যাটেলাইটটির নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস এটি পর্যবেক্ষণ করবে।
থ্যালেস প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে স্যাটেলাইটটি পর্যবেক্ষণের কাজ করবে। এই সময়ে সক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলে এর দেখাশোনার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরই ছেড়ে দেবে ফরাসি কোম্পানিটি।
মহাকাশে কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে জয়দেবপুরের গ্রাউন্ড স্টেশনটিই স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। গ্রাউন্ড স্টেশনে কাজ করার জন্য ১৮ জন বাংলাদেশি তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে থ্যালেস। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২৬টি কেইউ-ব্যান্ড ও ১৪টি সি-ব্যান্ডের।
এটি তৈরিতে খরচ ধরা হয় ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এই ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি।
তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ বিষয়ে বলেন, ‘থ্যালেসের লোকজন আমাকে বলেছেন, আমাদের ১৮ জন ছেলেমেয়ে এখনই এই স্যাটেলাইট পরিচালনা করার দক্ষতা অর্জন করেছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের একটি বড় অর্জন।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল এই অর্জনে তাঁকে এবং দেশবাসীকে অভিবাদন ও শুভেচ্ছা ‘বাংলা নিউজ’ এর পক্ষ থেকে।
অনলাইন বাংলা নিউজ বিডি :/ এস এস
Leave a Reply